Header Ads Widget

‘জুলাই হত্যা’ মামলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রতিশোধ হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত!

  

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সাভারের বাসিন্দা মো. সোহেল রানা (৩৭) ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। সেই ঘটনায় যাত্রাবাড়ী

থানায় মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ পুলিশের কিছু সাবেক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার আসামির তালিকায় বিএনপির পদধারী নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়স্বজনেরও নাম রয়েছে, যদিও এজাহারে তাদের আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া ৪৩ জন আসামির বাড়ি রাজধানীর বাইরে একই উপজেলায় হওয়ায় মামলাটি ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠেছে।


মামলার আসামির তালিকায় উল্লেখযোগ্য অসংগতির কারণে আমাদের অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলাটিতে স্থানীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রতিশোধ নিতে ৪৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার এই ব্যক্তিদের মধ্যে ২০২২ সালের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের শত্রুতার প্রেক্ষিতে এ মামলায় তাদের জড়ানো হয়। আইনজীবীদের মতে, গণঅভ্যুত্থানে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতিটি ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তবে এই ধরনের ‘ভুয়া’ আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত করলে তদন্তে অতিরিক্ত সময় লাগবে, যা বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে এবং বাদী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এছাড়া নির্দোষ ব্যক্তিদের আসামি করলে হয়রানি এবং গ্রেপ্তার বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়।


নথিপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, নিহত সোহেল রানার ছোট ভাই মো. জুয়েল (৩৪) মামলার বাদী হিসেবে ঢাকার আদালতে আবেদন করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে গত ২০ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা রেকর্ড করা হয়। এজাহারে নিহত সোহেল রানা ও বাদী মো. জুয়েলের ঠিকানা হিসেবে সাভার পৌরসভার ২৫৫ পশ্চিম রাজাশন এলাকা উল্লেখ করা হয়, এবং তাদের বাবার নাম মো. লাল মিয়া ও মায়ের নাম রামিদা বেগম দেওয়া হয়।


কিন্তু, ওই ঠিকানায় গিয়ে ২৫৫ পশ্চিম রাজাশন নামে কোনো বাসার খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও সোহেল রানা নামে কেউ গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়া এজাহারে থাকা মোবাইল নম্বরে এক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার চারবার নম্বরে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ ছিল।


সন্দেহ দেখা দেওয়ায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের তালিকা যাচাই করা হয়, কিন্তু সেখানে সোহেল রানা নামে কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এমন কোনো তথ্য মেলেনি।


আসামির তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ৪৩ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ও বাবার নামও দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সাভারের বাসিন্দা বাদী কীভাবে অন্য উপজেলার আসামিদের এমন বিস্তারিত তথ্য জানলেন?এজাহারের ১৩৪ নম্বর আসামি আক্কাস মাদবর হচ্ছেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ৭১ নম্বর আসামি সুরুজ মাতবর বিএনপির সহসভাপতি, আর ১১২ নম্বর আসামি টিটু আকন জাজিরা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক এবং বর্তমানে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়া, ১৪২ ও ১৪৩ নম্বর আসামি বাকিবিল্লা মাল ও বাহাউদ্দিন মাল, দুই ভাই, এবং ১৪৪ নম্বর আসামি নুরু বেপারি সকলেই বিএনপির সমর্থক। এজাহারে দেখা গেছে, বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তন করে তাদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা অন্যান্য দলের নেতাকর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 


জাজিরা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আক্কাস মাদবর বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পতনের আন্দোলন করে আসছিলেন। অথচ তাদেরকে এখন আওয়ামী লীগ নেতা সাজিয়ে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলাটিতে জাজিরার ১৭ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে এবং টাকার বিনিময়ে তাদের এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিষয়টি জেলা ও কেন্দ্রীয় বিএনপিকে জানানো হয়েছে।


বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক টিটু আকনও বলেন, মামলার আসামি তালিকায় শুধুমাত্র পদধারী নেতাকর্মীরাই নন, তাদের আত্মীয়-স্বজনও যুক্ত রয়েছেন, যারা বিএনপির সমর্থক। স্থানীয় দ্বন্দ্বের জেরে বাদীকে টাকা দিয়ে তাদেরকে আসামি করা হয়েছে বলে তিনি জানান।


এজাহারে আরও অনেক ব্যক্তির নাম রয়েছে, যারা একই এলাকায় বসবাস করেন এবং এজাহারে তাদের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের নেতাকর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মী ছাড়াও মামলার আসামির তালিকায় রয়েছেন ৫৭ নম্বরে রিপন হোসেন ফাহিম, ৫৯ নম্বরে খালেক মাতবর, ৬০ নম্বরে বাবু মাতবর, ৬১ নম্বরে জিভুল মাতবর, ৭৭ নম্বরে জামাল খান, ৭৮ নম্বরে শ্যামল শেখ, ৭৯ নম্বরে সুজন সরদার। এছাড়াও তিন ভাই যথাক্রমে ৮৩ নম্বরে আতিকুর রহমান খান আব্বাস, ৮৪ নম্বরে রিপন খান ও ৮৫ নম্বরে লিটন খান। ৮৬ নম্বরে মো. আলম, ৮৭ নম্বরে সুমন খান ও তার ভাই রাজ্জাক খান (৯১ নম্বর)। আরও আছেন ৮৮ নম্বরে বাদল সরদার, ৯০ নম্বরে আউয়াল সারেং, ৯৪ নম্বরে আক্তার হোসেন বেপারি, ৯৬ নম্বরে মো. শাওন, ৮৬ নম্বরে লিয়াকত মাতবর, ৯৭ নম্বরে সুমন মুন্সী, ৯৮ নম্বরে নোয়াব আলী মাতবর, ১০০ নম্বরে ইউসুফ খাঁ, ১০১ নম্বরে কামাল কাজী, ১০২ নম্বরে রাকিব কাজী, ১০৪ নম্বরে মীর হোসেন। এছাড়াও ১২৪ নম্বরে উত্থান শেখ, ১৩০ নম্বরে জালাল জমাদ্দার, ১৩১ নম্বরে আব্দুল জলিল মাতবর, ১৩২ নম্বরে লুৎফর খলিফা, ১৪০ ও ১৪১ নম্বরে আপন দুই ভাই কামাল খলিফা ও জামাল খলিফা, ১৪৫ নম্বরে মিঠুন মোল্লা, ১৪৬ নম্বরে স্বপন খাঁ, ১৪৭ নম্বরে সোহরাব খান এবং ১৪৮ নম্বরে ফারুক মোল্লা। এজাহারে তাদের সবাইকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের নেতাকর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।


স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই আসামিদের বেশিরভাগই একই এলাকার বাসিন্দা এবং কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। যদিও তাদের কয়েকজন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কেউই ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীতে সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না।


স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মূলত বিলাসপুর ইউপি নির্বাচনের দ্বন্দ্বের কারণে এই মামলায় জাজিরার লোকজনকে আসামি করা হয়েছে। ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে বিজয়ী হন কুদ্দুস বেপারি, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জলিল মাতবর, যিনি মামলার ৫৮ নম্বর আসামি। বিএনপির নেতাকর্মী ছাড়া এই মামলার অন্য আসামিরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও শরীয়তপুর-১ (সদর-জাজিরা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম মোজাম্মেল হকের অনুসারী। অপরদিকে, ইউপি চেয়ারম্যান কুদ্দুস বেপারি সাবেক সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর অনুসারী। মূলত ইউপি নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেই মামলায় এই আসামিদের নাম এসেছে। উল্লেখ্য, এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় রিয়াজুল তালুকদার হত্যাকাণ্ডে কুদ্দুস বেপারীসহ জাজিরার অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে আসামি করা হয়েছিল, যদিও সেই মামলায় সোহেল রানা হত্যাকাণ্ডের কোনো আসামির নাম ছিল না।জাজিরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তিন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ১০ সেপ্টেম্বরের মামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই মূলত ২০ সেপ্টেম্বর সাভারের সোহেল রানা হত্যাকাণ্ডে জাজিরার বাসিন্দাদের আসামি করা হয়েছে। বিএনপির যারা এই মামলায় আসামি, তাদের অনেকেই পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জলিল মাতবরের অনুসারী।


আসামি জলিল মাতবর কালবেলাকে জানান, পুরোনো দ্বন্দ্বের জেরে কুদ্দুস বেপারির সহযোগিতায় জাজিরার লোকজনকে আসামি করা হয়েছে। কারণ, সাভারের বাদীর পক্ষে জাজিরার লোকদের বাবার নাম বা ঠিকানা জানা সম্ভব নয়। তিনি দাবি করেন, যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা কেউই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এটি শুধুমাত্র হয়রানি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে করা হয়েছে।


অন্যদিকে, বিলাসপুর ইউপি চেয়ারম্যান কুদ্দুস বেপারি কালবেলাকে বলেন, তিনি বাদীকে চিনেন না এবং এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।


ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর মতোই, এই মামলাতেও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আসামি করা হয়েছে। এ ধরনের মামলাগুলোতে নাম বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, যা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি করবে এবং বিচার পেতে দেরি হবে।


তিনি আরও বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, প্রতিটি আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য কি না। মিথ্যা হলে চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়া যাবে, তবে এতে সময় লাগবে এবং বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। এর মধ্যে নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানির সম্ভাবনাও থাকে, বিশেষ করে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।


মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা, যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক মো. ইফাত আহম্মেদ জানান, মামলাটি পুরোপুরি তদন্ত শুরু করতে পারেননি এবং কোনো আসামি এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। তবে মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তিনি স্বীকার করেন, আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং দোষী-নির্দোষ চিহ্নিত করতে তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগবে।


পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, আসামিরা একই এলাকার হওয়ায় এটি কোনো বড় বিষয় নয়। তবে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে নির্দোষ ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আসামিরা ঘটনাস্থলের না হলেও অন্য এলাকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব হবে দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা। যদি মামলায় মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে যারা এটি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ২১১ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

Cr:KB

Post a Comment

0 Comments